শেরশাহ ও শূর সাম্রাজ্য: শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা:


বহুলুল লোদী হলেন প্রথম আফগান যিনি ১৪৫১ খ্রিঃ দিল্লীর মসনদে বসেন। দ্বিতীয় আফগান শাসন শুরু করেন শেরশাহ (১৫৪০ সাল)। শেরশাহের প্রকৃত নাম ফরিদ খাঁ বা শের খাঁ। বাবা হাসান ছিলেন শূরবংশীয় ও বিহারের সাসারামের জায়গীরদার। শেরশাহ বিহারের সুলতান বাহার খাঁ লোহনীর অধীনে চাকরী করতেন। ১৫৩৪ সালে (সূরজগড়ে যুদ্ধে) বিহারের নাবালক শাসক জালাল খাঁ লোহানী এবং বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন মামুদ শাহের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে নিজেকে বিহারের সুলতানরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৫৩৭ সালে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন মামুদকে পরাজিত করে বাংলা অধিকার করেন। ইনিই ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান। ১৫৩৮ সালে তিনি রোটাস দুর্গ জয় করেন। ১৫৪০ সালে দিল্লীর মসনদে বসেন। ১৫৪৫ সালে কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ কালে বারুদের স্তূপে আগুন লেগে মারা যান। বিহারের সাসারামে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শেরশাহ জমি জরিপ করার প্রথা চালু করেন। শেরশাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর মেজ ছেলে ইসলাম শাহ (১৫৪৫-১৫৫৪ সাল)। সিকান্দার শূর হলেন শূরবংশের শেষ সম্রাট।


কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা:
শেরশাহ সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা হলেও, স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। বিশিষ্ট মন্ত্রীদের পরামর্শ নিয়েই তিনি শাসনকার্য চালাতেন। এইসব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন,
  • 'দেওয়ান-ই-উজিরাৎ' (প্রধানমন্ত্রী)।
  • 'দেওয়ানই-আরজ’ (রাজস্বমন্ত্রী)।
  • 'দেওয়ান-ই-রিসালৎ’ (সচিব)।
  • 'দেওয়ান-ই-ইনসা' (সামরিক বিভাগের মন্ত্রী)। 
এই চার বিভাগকে সাহায্য করতেন,
  • ‘দেওয়ান-ই-কাজি’ (প্রধান বিচারপতি)।
  • ‘দেওয়ান-ই-বারিদ’ (গুপ্তচর বিভাগ)।

প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা:
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শেরশাহ বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করে সমগ্র সাম্রাজ্যকে। ৪৭টি শিক বা সরকারে ভাগ করেন। প্রতিটি সরকার বা প্রদেশে একজন ‘শিকদার-ই-শিকদারান’ (সামরিক দায়দায়িত্ব ও আইন শৃঙ্খলার রক্ষক) এবং একজন ‘মুনসিফ-ই-মুনসিফান’ (দেওয়ানি মামলার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী) নিযুক্ত ছিলেন।

       প্রতিটি সরকারকে তিনি কয়েকটি পরগনায় ভাগ করেন। পরগনার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ছিলেন, শিকদার, মুনসেফ, আমিন, কানুনগাে, কারকুন (হিসাবরক্ষক), খাজাঞ্চি (খাজনা আদায়কারী), চৌধুরি, পাটোয়ারি প্রমুখ। প্রতিটি পরগনাকে আবার অনেক গ্রামে ভাগ করা হয়েছিল গ্রামের শাসনভার গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর ছিল। বিকেন্দ্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা গঠিত হলেও ঐতিহাসিক কিন (Keen) বলেন, 'তার সমগ্র শাসনব্যবস্থা ঐক্যের নীতির উপর স্থাপিত ছিল।'

ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা:
সর্বপ্রথম শেরশাহের রাজস্বমন্ত্রী জমি জরিপ করে জমির উর্বরতার উপর ভিত্তি করে, সমগ্র কৃষিযােগ্য জমিকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলে—
  • সরেস (অতি উর্বর)।
  • মাঝারি (উর্বর)।
  • নিরেস (কম উর্বর)।

উর্বরতা অনুযায়ী তিনি ৩ ভাগের ১ ভাগ  থেকে ৪ ভাগের ১  ভাগ রাজস্ব ধার্য করেন। রাজস্ব নগদ অর্থে বা শস্যের মাধ্যমে প্রদান করা যেত। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই খাজনা আদায় করা হতভূমিরাজস্ব ছাড়া ‘মহাসিলানা’ (রাজস্ব আদায়কারীর জন্য কর বাবদ অর্থ), জুরিবানা (জমি জরিপকারীর জন্য কর বাবদ অর্থ) এবং ‘সেস কর’ (বিঘাপ্রতি ২এর হাফ টাকা আদায় করা হত দুর্ভিক্ষ বা মহামারির সময় অনুদানের জন্য) আদায় করা হত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় খাজনা মকুবের ব্যবস্থা ছিল। জোরজুলুম করে খাজনা আদায় করলে সেই কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হত)।

পাট্টা ও কবুলিয়ত:
শেরশাহ প্রথম জমির উপর প্রজার স্বত্ব স্বীকার করে মপ্রতিটি কৃষকের নামে একটি দলিল তৈরি করেছিলেন। এর নাম ‘পাট্টা’ (Title deed)। আর একটি দলিল হল সরকারি দলিল, যার নাম ‘কুবলিয়ত’ (Agreement deed)। এখানে কৃষকরা খাজনা প্রদানের অঙ্গীকার করতেন। ঐতিহাসিক মােরল্যান্ড (W. H. Moreland) শেরশাহের শাসনব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ব্যবস্থা বলে মন্তব্য করেছিলেন।

মুদ্রা ব্যবস্থা:
বাণিজ্যের উন্নতির জন্য শেরশাহ রুপার মুদ্রা রুপি এবং তামার পয়সা দাম প্রচলন করেছিলেন। তিনি স্বর্ণমুদ্রারও প্রচলন করেছিলেন বলে জানা যায়। পুরানাে সব খাদযুক্ত মুদ্রা তিনি বাতিল করে নতুন মুদ্রা চালু করেছিলেন। সীমান্ত অঞ্চলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যশুল্ক ছাড়া আর সব অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যশুল্ক তুলে দিয়েছিলেন আন্তঃবাণিজ্যের উন্নতির জন্য।

সামরিক ব্যবস্থা:
শেরশাহের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীতে ১,৫০,০০০ অশ্বারােহী, ২৫,০০০ পদাতিক, ৫,০০০ হস্তীবাহিনী ছিল। এছাড়া বন্দুক ও কামানবাহিনী ছিল। সেনাদের নিয়ােগের সময় যােগ্যতা ও আনুগত্য পরীক্ষা করা হত। জায়গিরের পরিবর্তে নগদ বেতন দেওয়া হত। বদলিরও নিয়ম ছিল। আলাউদ্দিন-এর মতাে তিনি অশ্বারােহী বিভাগে ‘দাগ’ ও ‘হুলিয়া’ প্রথা চালু করেছিলেন। শক্তিশালী পুলিশ বাহিনীও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিল। ‘মহতাসিব’ নামে কর্মচারীরা জনগণের নৈতিকতা ও মূল্যবােধের প্রতি লক্ষ রাখত। ব্রহ্মজিৎ গৌড়ের মতাে ব্রাহ্মণ প্রধান সেনাপতি ছিলেন।

বিচার ব্যবস্থা:
শেরশাহের বিচারব্যবস্থা কঠোর ও নিরপেক্ষ ছিল। ‘কাজি-উল-কাজান’ (প্রধান কাজি) মুসলিম আইন অনুসারে মুসলমানদের দেওয়ানি মামলার বিচার করতেন। ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন শিকদার। এই বিভাগের প্রধান কর্মচারী ছিলেন 'মির-ই-আদল'। রাজস্ব-বিষয়ক মামলার বিচারে ছিলেন। মনসেফ বিচারের রায় নিরপেক্ষ ও কঠোর ছিল। দোষীকে প্রাণদণ্ড, অঙ্গচ্ছেদ ও বেত্রাঘাত করা হত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতি বুধবার শেরশাহ নিজেই আপিল মামলার। শুনানিতে উপস্থিত থেকে বড়াে বড়াে মামলার নিষ্পত্তি করতেন।

যোগাযোগ ও ডাক ব্যবস্থা:
শেরশাহর উদ্যোগে বহু রাস্তা তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে আগ্রা থেকে যােধপুর, আগ্রা থেকে বুরহানপুর, লাহাের থেকে মুলতান রাজপথগুলি উল্লেখযােগ্য। সােনারগাঁও (ঢাকা) থেকে সিন্ধুর থাট্টা পর্যন্ত দীর্ঘ রাজপথটির নাম ‘সড়ক-ই-আজম’ (গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রােড) যা ১৪০০ মাইল লম্বা। ঐতিহাসিক আব্বাস খান শেরওয়ানি বলেন, 'রাজপথগুলির দুধারে তিনি মােট ১৭০০ সরাইখানা তৈরি করেছিলেন।' অনলা-ই-ডাকাকিব এখানে 'দারােগা-ই-চৌকি’র ব্যবস্থা ছিল। দারােগা-ই-চৌকির মাধ্যমে তিনি ঘােড়ার পিঠে ডাক যােগাযােগের ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া বহু গুপ্তচর শেরশাহকে নানাভাবে সাহায্য করতেন।

      শেরশাহ খয়রাতি খাতে প্রতি বছর ১৮,২৫,০০০ টাকা দান করতেন। শিল্পানুরাগী শেরশাহ ‘রােটাসগড় দুর্গ’, ‘পুরানা কিল্লা’, ‘কিলা-ই-কুহনা' মসজিদ, সাসারামে তাঁর সমাধিসৌধ মৃত্যুর আগে তৈরি করে গিয়েছিলেন। তিনি ইন্দো-পারসিক শিল্পরীতির সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। একজন সুন্নি মুসলমানরূপে তিনি জিজিয়া কর আরােপ, হিন্দু মন্দির ধ্বংস করলেও গোঁড়া মৌলবাদী উলেমাদের দ্বারা প্রভাবিত হননি। প্রজাদের ভালাের জন্য সবই করেছিলেন। তাই তার বিরুদ্ধে যা কিছু। সমালােচনা সবই আদর্শের মানদণ্ডে তুচ্ছ। তার প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও মপরিকাঠামাে। আগামী প্রজন্মের কাছে বড়াে উপহার ছিল। কিন বলেন, 'এই পাঠানের মতাে এমন বিজ্ঞতা কেউ দেখতে পারেননি—এমনকি ব্রিটিশ সরকারও নয়।'

Post a Comment for "শেরশাহ ও শূর সাম্রাজ্য: শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা:"