সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (The United Nations Organization).


সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গঠন:

প্রতিটি যুদ্ধের বিভীষিকা ও নৃশংসতা মানুষকে শান্তিকামী করে তোলে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন এমন একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক সংগঠনের, যেখানে শান্তিকামী রাষ্ট্রগুলি সমবেত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের বিরোধ মিটিয়ে নেবে এবং সম্মিলিত- ভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা ভঙ্গকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৯) পর 'জাতিসংঘ' (The League of Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাতিসংঘের অপমৃত্যু ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা, মারণাস্ত্রের অভিনবত্ব ও ধ্বংসলীলা, অগণিত মানুষের প্রাণনাশ প্রভৃতি সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে পুনরায় শান্তিমুখী করে তোলে। তাঁরা ১৯৪১ সালের ১৪ ই আগস্ট থেকে ১৯৪৫ সালের ২৬ শে জুন পর্যন্ত নানা সম্মেলন ও আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে 'সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ' বা 'রাষ্ট্রসংঘ' (The United Nations Organization) নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালের ২৪ শে অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের লক্ষ্য:
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের 'সনদ' (Charter) -এর মোট ১১১ টি ধারা (Articles) এবং একটি ‘প্রস্তাবনা’ (Preamble) রয়েছে।
প্রস্তাবনার মধ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মূল লক্ষ্যগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলি হল –

  • আগামীকালের যুদ্ধের নিগ্রহ থেকে আমাদের বংশধরদের রক্ষা করা।
  • মৌলিক মানবাধিকার, প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও উৎকর্ষ এবং নারীপুরুষ ও ক্ষুদ্রবৃহৎ জাতি - নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকারের প্রতি পুনরায় গভীর আস্থা স্থাপন করা।
  • আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা উদ্ভুত বাধ্যবাধকতার প্রতি সুবিচার ও সম্মান প্রদর্শনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
  • সামাজিক প্রগতি ও ব্যাপকতর স্বাধীন পরিবেশের মধ্যে থেকে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।

এইসব লক্ষ্য পূরণের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলি
  • সহনশীলতার নীতি অনুসরণ ও সুপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব নিয়ে পরস্পর শান্তিতে বসবাস করবে।
  • আন্তর্জাতিক শান্তি নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিজেদের শক্তি সুসংহত করবে।
  • যৌথ স্বার্থরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কারণে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে না।
  • সব মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনকে কাজে লাগাবে। প্রস্তাবনায় একথাও বলা হয়েছে যে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্য রাষ্ট্রগুলি পূর্বোক্ত লক্ষ্য-সমূহের বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাবে।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য:
সনদের ১ নং ধারা অনুসারে—
আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা হল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রধানতম উদ্দেশ্য। এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পথে যেসব বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে, ঐক্যবদ্ধভাবে সব সদস্য -রাষ্ট্র সেইসব বাধাবিপত্তি অপসারণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হবে। তা ছাড়া, ন্যায়নীতি ও আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসংবাদের সুষ্ঠু সমাধান করাও হল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রাথমিক কর্তব্য।
'মানুষের সমানাধিকার’ ও ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ স্বীকার করে নিয়ে জাতিগুলি পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং স্থায়ীভাবে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবতাবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নীতি সব রাষ্ট্রই অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। জাতিধর্মবর্ণ ও স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
জাতিগুলির কার্যাবলি সুসংহত করে উপরিউক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নীতি:
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্যগুলির বাস্তব রূপায়ণের জন্য সাতটি নীতি অনুসরণের কথা সনদে ঘোষিত হয়েছে।
এই নীতিগুলি হল –
  • সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ক্ষুদ্রবৃহৎ সব সদস্য রাষ্ট্রই সমান।
  • সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য সব সদস্য - রাষ্ট্র সনদ কর্তৃক আরোপিত দায়দায়িত্ব নিষ্ঠা সহকারে পালন করবে।
  • সদস্য রাষ্ট্রগুলি শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের বিরোধের মীমাংসা করবে।
  • আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলি কোনো রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এলাকা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করবে না।
  • সব সদস্য-রাষ্ট্র সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করবে।
  • যেসব রাষ্ট্র সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্য নয়, তারাও যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সনদের নীতিগুলি মেনে চলে সে বিষয়ে লক্ষ রাখা হবে।
  • সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কোনো রাষ্ট্রের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ (domestic jurisdiction) -এ হস্তক্ষেপ করবে না।

Post a Comment for "সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (The United Nations Organization)."