লক্ষ্মৌ চুক্তির শর্তাবলী ও গুরুত্ব:
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মৌ শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মধ্যে লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বাল গঙ্গাধর তিলকের ভূমিকা:লক্ষ্মৌ শহরে যখন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশনের পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অধ্যাবসায়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ একটি পারস্পরিক সমঝোতায় উপনীত হন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে উভয় দলের মধ্যে লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
লক্ষ্মৌ চুক্তির শর্তাবলী:
- মুসলিম লীগ কংগ্রেসের স্বরাজ বা স্বায়ত্তশাসনের নীতি মেনে নেবে। অন্যদিকে কংগ্রেসও মুসলিম লীগের পৃথক নির্বাচনের নীতিকে স্বীকৃতি জানাবে।
- প্রতিটি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক–তৃতীয়াংশ সদস্য হবেন মুসলিম প্রতিনিধি।
- মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সদস্যরা যৌথ ভাবে স্বরাজ আদায়ের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে।
- উভয় দলই স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট দিন, তারিখ প্রভৃতি ঘোষণার দাবি জানাবে।
- ভারত কাউন্সিল বিলুপ্ত হবে এবং ভারতে স্বায়ত্তশাসিত সরকার থাকবে।
- গভর্নরের নির্বাহী কাউন্সিলে একই প্রক্রিয়া প্রয়োজ্য।
- আইন সভার মেয়াদ হবে ৫ বছর।
- ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্য অবশ্যই ভারতীয় হবে।
লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্ব:
নানাধরনের বিরূপ সমালোচনা থাকলেও তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যেমন –
লীগ–কংগ্রেস ঘনিষ্ঠতা:
এই চুক্তির ফলে মুসলিম লীগ ও জাতীয় কংগ্রেস নিজেদের তিক্ততা ভুলে পুনরায় মিলিত হয়। তারা মিলিত ভাবে ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়।
হিন্দু–মুসলিম ঐক্য:
এই চুক্তির মাধ্যমে হিন্দু–মুসলমান পুনরায় পরস্পরের কাছাকাছি আসে। এই চুক্তি প্রমাণ করে দেয় যে ধর্মীয় পার্থক্য থাকলেও জাতীয় প্রয়োজনে দুই সম্প্রদায়ের মিলন সম্ভব।
জনমানসে উদ্দীপনা:
নরমপন্থী নেতৃবর্গের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ এবং চরমপন্থী নেতৃবর্গের মধ্যে তিলক এই চুক্তি সমর্থন করেন। এর ফলস্বরূপ সার্বিকভাব জনমানসে এক রাজনৈতিক উদ্দীপনা তৈরি হয়।
ব্রিটিশ সরকারের অস্বস্তি:
এতদিন ধরে সরকার দমন পীড়ন ছাড়াও বিভেদ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করতে। কিন্তু লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকারের সেই বিভেদ নীতির অস্ত্র অনেকটাই ভোঁতা ও অকেজো হয়ে যায়।
স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ঘোষণা:
এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতীয়তাবাদী জনমতকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে আনার লক্ষ্যে ভারত সচিব মন্টেগু এক ঘোষণায় (১৯১৭ খ্রিস্টপূর্ব) বলেন যে, ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে স্বায়ত্তশাসন দানই ব্রিটিশ সরকারের নীতি।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এই চুক্তি স্বাক্ষর করে এক অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। মহাত্মা গান্ধীও এই নীতির সমালোচনা করেছিলেন। তাস্বত্ত্বেও লক্ষ্মৌ চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু–মুসলিম ঐক্য ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল।
Post a Comment for "লক্ষ্মৌ চুক্তির শর্তাবলী ও গুরুত্ব:"