বৈদিক সভ্যতার স্রষ্টা হল আর্য। আর্য কথার অর্থ ‘সৎ বংশজাত‘ বা অভিজাত মানুষ। অনেকে আর্য বলতে একটি জাতির নাম বলে মনে করেন। ম্যাক্সমুলার মনে করেন আর্য কোনো জাতির নাম নয়, এটি একটি ভাষাগত ধারণা।
বৈদিক সভ্যতার সময়কাল:
বেদের রচনাকালের উপর ভিত্তি করে বৈদিক যুগকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ঋক বৈদিক যুগ ও পরবর্তী বৈদিক যুগ। ঋকবেদে আর্য সভ্যতার যে যুগের কথা বলা হয়েছে তাকে ঋক-বৈদিক যুগ এবং অন্যান্য বেদসমূহ ও বৈদিক সাহিত্যে যে যুগের কথা বলা হয়েছে তাকে পরবর্তী বৈদিক যুগ বলা হয়। মোটামুটিভাবে ঋক-বৈদিক যুগের কালসীমা হল খ্রিঃ পূঃ ১৫০০ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের কালসীমা হল খ্রিঃ পূঃ ১০০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে আমরা বৈদিক যুগ বলতে পারি।
বৈদিক সভ্যতার নামকরণ:
সমগ্র আর্য জাতি তথা মনুষ্য জাতির প্রাচীনতম সাহিত্য হল বেদ। বেদ থেকে আমরা সমকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য জানতে পারি। তাই এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয়।
আর্যদের আদি বাসস্থান তত্ত্ব:
আর্যদের আদি বাসস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে এসেছেন আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন আর্যরা ভারতের প্রাচীন অধিবাসী। তবে বর্তমানে অধিকাংশ ঐতিহাসিক অধ্যাপক ব্রান্ডেনস্টাইনের মতকেই গ্রহণ করেছেন। তাঁর মত অনুসারে মধ্য এশিয়ার স্তেপি অঞ্চলেই ছিল আর্যদের আদি নিবাস এবং এখান থেকেই তাদের একটি শাখা ইউরোপে ও অপর একটি শাখা পারস্য হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। আর্যরা প্রথমে সপ্তসিন্ধু (সরস্বতী, সিন্ধু ও সিন্ধুর পাঁচটি উপনদী ঝিলাম বা বিতস্তা, চেনাব বা চন্দ্রভাগা, রভি বা ইরাবতী, বিয়াস বা বিপাশা ও সতলেজ বা শতদ্রূ) অঞ্চলে (মূলত পাঞ্জাব) বসবাস করত। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ও যাযাবর বৃত্তি পরিত্যাগ করে কৃষিকার্যকে উপজীবিকা হিসাবে গ্রহণ করার পর তারা পূর্ব দিকে গঙ্গা – যমুনা বিধৌত অঞ্চলে বন কেটে বসতি স্থাপন করে। এই ভাবে পরবর্তী বৈদিক যুগে তারা বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পরে তারা বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতের দিকেও অগ্রসর হয়।
আর্যদের সামাজিক জীবন:
ঋক বৈদিক যুগে সমাজের মূল ভিত্তি ছিল পরিবার৷ পরিবারগুলি ছিল পিতৃতান্ত্রিক ও একান্নবর্তী। পরিবারকে বলা হত ‘কুল‘। পরিবারের সর্বাপেক্ষা বয়স্ক পুরুষ ছিল সর্বপ্রধান ব্যক্তি। তাকে ‘গৃহপতি‘ বা ‘কুলপ‘ বলা হত।
বৈদিক যুগের নারীর মর্যাদা:
সমাজে নারীর স্থান ছিল সম্মানজনক। স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ধর্মাচরণ অংশগ্রহণ করতে পারতেন। পিতৃগৃহে কন্যাদের শিক্ষাদানের রীতি ছিল। বেদ পাঠ ও উপনয়নের অধিকারিণী ছিলেন। মমতা, বিশ্ববারা, ঘোষা, অপালা, লোপামুদ্রা, শিকতা, নিভাবরী প্রমুখ বেদমন্ত্র রচনা করেছিলেন। মৈত্রেয়ী, গার্গী প্রমুখ দর্শনশাস্ত্রে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন।
বৈদিক সমাজের বিবাহ:
পুরুষদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও নারীদের মধ্যে তা অপ্রচলিত ছিল। বিবাহ অনুষ্ঠান হত কন্যার পিতৃগৃহে। তখনকার সময়ে সমাজে বিধবা বিবাহ ও পণপ্রথা প্রচলন ছিল। সতীদাহ প্রথা, পর্দা প্রথা ও বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিল না।
আর্যদের পোশাক পরিচ্ছদ:
আর্যদের পোশাক তিনভাগে বিভক্ত ছিল।
যথা— নিবি বা এক ধরনের অন্তর্বাস, বাস বা পরিধান ও অধিবাস বা দ্রাপি (ওড়না)। এইসব পোশাক তৈরি হত সুতো, পশম ও হরিণের চামড়া দিয়ে। সোনা, রুপো ও দামি পাথরের অলংকার এবং ফুলের মালা আর্য নারীরা ব্যবহার করত। উৎসবের দিনে নারী পুরুষ উভয়েই পাগড়ি পরত। আর্যরা বড় চুল রাখতে ভালোবাসত ও চিরুনি দিয়ে তা সুবিন্যস্ত করত।
আর্যদের খাদ্যাভ্যাস:
খাদ্য হিসাবে আর্যরা চাল, গম, যব, ফল, সবজি, মাছমাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ব্যবহার কত। তারা ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, গো-মাংস ভক্ষন করত, তবে গাভি হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। আর্যরা সুরা ও সোমরস পান করত। তবে সুরাপান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।
আর্যদের আমোদপ্রমোদ:
নাচ, গান, মৃগয়, রথের দৌড়, পাশাখেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, ধনুর্বাণ প্রতিযোগিতা প্রকৃতি ছিল আর্যদের আমোদ প্রমোদের প্রধান উপকরণ। বৈদিক যুগে সংগীত বিদ্যা ও চারুকলার খুবই উন্নতি হয়েছিল। ঋকবেদে বাঁশি, বীণা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে।
প্রাচীন ভারতে বর্ণপ্রথা:
আর্য সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এই চারটি শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল।
ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ‘পুরুষ সূক্ত‘ নামক স্ত্রোত্র অনুযায়ী ব্রহ্মার মুখ থেকে বাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য ও পদদ্বয় থেকে শূদ্রর উৎপত্তি হয়েছে।
- ব্রাহ্মণ: যাঁরা পূজার্চনা বা বিদ্যাচর্চার সাথে যুক্ত ছিলেন।
- ক্ষত্রিয়: যাঁরা যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন।
- বৈশ্য: যাঁরা কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।
- শুদ্র: উপরোক্ত তিন শ্রেণীর সেবাকার্যে নিযুক্ত থাকা শ্ৰেণী।
চতুরাশ্রম ব্যবস্থা:
ঋক-বৈদিক যুগের শেষ পর্বে চতুরাশ্রম প্রথার উদ্ভব হয়। চারটি আশ্রমের নাম হল-
- ব্রহ্মচর্য: ব্রহ্মচর্য পর্যায়ে প্রত্যেক পুরুষকে গুরুর গৃহে অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো।
- গার্হস্থ্য: ব্রহ্মচর্য শেষ করে আপন গৃহে ফিরে এসে বিবাহ করে সংসারধর্ম পালন করা ছিল এই পর্যায়ের অঙ্গ।
- বাণপ্রস্থ: প্রৌঢ় অবস্থায় সংসার থেকে দূরে একাকী অরণ্যবাসী হয়ে ধর্মানুষ্ঠানে ও ঈশ্বর চিন্তায় কালযাপন।
- সন্ন্যাস: শেষ জীবনে সকল সংসারিক বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাস অবলম্বন করে পরমাত্মার চিন্তায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখা।
আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন:
আর্যদের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে ধান ও যব ছিল প্রধান- যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কর্ষণযোগ্য ভূমিকে বলা হত ভূমি বা উর্বরা। কৃষিতে জলসেচের ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে লোহার লাঙল ব্যবহার প্রচলিত হয়। কৃষিক্ষেত্র ও বাস্তুজমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত ছিল। কিন্তু গোচারণের জন্য খাস জমির ওপর যৌথ মালিকানা ছিল।
কৃষি ও পশুপালন: গৃহপালিত পশুর মধ্যে গোরু, কুকুর, ছাগল, ঘোড়া ও ভেড়া ছিল প্রধান। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গোরুর গুরুত্ব ছিল বেশি। গো সম্পদ লুণ্ঠন ও পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ হত। গরুকে হত্যা করা যায় না বলে ‘অগ্ন্য‘ বলা হত। গো সম্পদ হরণের যুদ্ধকে বলা হত গাভিষ্টি। যুদ্ধের সময় ঘোড়ার ব্যবহার প্রচলন ছিল।
ব্যবসা-বাণিজ্য: কৃষিকার্য ও পশুপালন ছাড়া আর্যরা ব্যবসাবাণিজ্যও করত। পনি নামে এক শ্রেণীর মানুষ এই কাজে লিপ্ত ছিল। কাপড় ও চামড়া ছিল বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ব্যাবসাবাণিজ্য চলত। গো-ধন ছিল বিনিময়ের মাধ্যম। অবশ্য এই যুগে ‘নিষ্ক’ ও ‘মনা ’ নামে ধাতব মুদ্রার কথা জানা যায়। স্থলপথে ঘোড়ায় টানা রথ ও বলদচালিত গাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। সমুদ্রপথে ব্যবসাবাণিজ্য চলত কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত নন।
বৈদিক যুগের শিল্প: আর্যদের প্রধান শিল্পকর্মের মধ্যে ছিল মৃৎশিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প, চর্যশিল্প। কারিগররা রথ, নৌকা, বাড়ি তৈরি করা ছাড়াও সূক্ষ খোদাই করা পাত্র তৈরি করত। কামারেরা লোহা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি তৈরি করত। স্যাকরা তৈরি করত সোনার গয়না।
বৈদিক যুগের রাজস্ব ব্যবস্থা: পরবর্তী বৈদিক যুগে ‘বলি‘ ও ‘শুল্ক‘ নামে দুই ধরনের রাজস্ব আদায় করা হত। ঋক-বৈদিক যুগে ‘বলি‘ প্রচলিত থাকলেও তা বাধ্যতামূলক ছিল না। বলি হল দান, প্রণামি বা উপহার। ব্রাহ্মন ও রাজপরিবারের লোকেদের কোন রাজস্ব প্রদান করতে হত না। রাজস্ব আদায় করতেন সংগ্রহিত্রী ও ভাগদুখ নামে দু – ধরনের রাজ কর্মচারী।
আর্যদের রাজনৈতিক জীবন:
রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। রাজা নিজেকে দেবতার প্রতিভূ বলেও ঘোষণা করেন। শতপথ ব্রাহ্মণ এ বলা হয়েছে যে, রাজ হলেন প্রজাপতি বা ব্রম্মার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। রাজাকে বলা হত ইন্দ্ৰ, অগ্নি, বরুণ, বায়ু, অর্ঘ প্রভৃতি দেবতার শক্তিতে বলশালী। এই সময় রাজারা সম্রাট, বিরাট, স্বরাট, একরাট, রাজচক্রবর্তী, ভোজ, সার্বভৌম, বিশ্বজনীন প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করতেন। রাজকর্মচারী রাজাকে শাসনকার্যে সাহায্য করতেন বিভিন্ন রাজকর্মচারী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন। পুরোহিত সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় কার্যে পুরোহিতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র বৈদিক যুগের প্রভাবশালী পুরোহিত ছিলেন । সেনানী পুরোহিতের পরেই ছিল সেনানী বা প্রধান সেনাপতির স্থান। তার কাজ ছিল যুদ্ধ কালে রাজাকে সাহায্য করা। শান্তির সময় তাকে অসামরিক কাজকর্ম করতে হত। দূত কূটনৈতিক কাজে রাজাকে সাহায্য করতেন। গুপ্তচর রাজাকে রাজ্যর নানা বিষয়ে অবহিত করতেন। ব্রজাপতি গোচারণভূমি দেখাশোনা করত। স্থপতি সীমান্ত অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী।
বৈদিক যুগের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা:
বৈদিক যুগে কোনো বড়ো রাষ্ট্র বা সম্রাজ্যের উদ্ভব হয়নি। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হত গ্রাম, গ্রামের প্রধান গ্রামনি। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হত বিশ, বিশের প্রধান বিশপতি। বিশের সমষ্টিকে বলা হত জন। জনের প্রধান ছিল গোপা। একশোটি গ্রামের শাসন দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন শতপতি।
বৈদিক যুগের বিচারব্যবস্থা:
বিচারব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানে। বিচারকার্য পরিচালনায় দায়িত্বে ছিলেন অধ্যক্ষ। অপরাধীকে ধরে আনার জন্য পুলিশ ছিল তাদের উগ্র বলা হত, বিবাদের মধ্যস্থতা করতেন মধ্যমাসি। সভা ও সমিতি নামে দুটি জনসাধারণের প্রতিষ্ঠান ছিল। রাজা ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ নিয়ে গুরত্বপূর্ণ রাজকার্যসমূহ পরিচালনা করতেন। সমিতির অধিবেশনে রাজপুত্র ও জনগণ অংশ নিতেন। সভা ছিল বয়ষ্কদের পরিষদ।
আর্যদের ধর্মীয় জীবন:
আর্যরা কোনো মূর্তিপূজা করত না। আর্যরা প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতারূপে কল্পনা করত এবং তার উপাসনা করত। এই যুগে ইন্দ্ৰ ছিলেন শ্রেষ্ঠ দেবতা- দেবরাজ। তিনি বৃষ্টির দেবতা ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যে ঋকবেদে ২৫০ টি স্তোত্র আছে। ঋকবেদে তাকে ‘পুরন্দর‘ অর্থাৎ দুর্গ ধ্বংসকারী বলা হয়েছে। ইন্দ্রের পরে স্থান ছিল অগ্নিদেবের। তাঁর উদ্দেশ্যে ঋকবেদে ২০০ টি স্তোত্র আছে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিলেন পাপপুণ্যের ধারক ও জলের দেবতা বরুণ।এছাড়া বৃক্ষের দেবতা সোম, বজ্রের দেবতা মরুৎ, বৃষ্টির দেবতা পজ্যন্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য দেবতা ছিলেন। অদিতি, উষা, সাবিত্রী, সরস্বতী ইত্যাদি দেবীর পূজা করা হত। যাগযজ্ঞ, বলিদান, প্রার্থনা প্রভৃতি ছিল আর্যধর্ম আচরণের প্রধান অঙ্গ।
বৈদিক সাহিত্য:
বৈদিক সাহিত্যেকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- বেদ ও বেদাঙ্গ। আর্যদের বসতি স্থাপন করার পর প্রথম দিকে বেদ রচিত হয় এবং পরবর্তীকালে রচিত হয় বেদাঙ্গ।
বেদ: ‘বিদ‘ শব্দের অর্থ জ্ঞান। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, বেদ মানুষের রচনা নয়, স্বয়ং ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাণী। এজন্য বেদকে ‘নিত্য‘ ও ‘অপৌরুষেয়‘ বলা হয়। আচার্য ও শিষ্য পরম্পায় শুনে শুনে মনে রাখা হত তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি।
বেদের চারটি অংশ- ঋক, সাম, যজু, ও অথর্ব।
ঋকবেদ: ঋকবেদ সবচেয়ে প্রাচীন। আনুমানিক ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঋগবেদ রচিত হয় বলে মনে করা হয়। প্রাকৃতিক বর্ণনা ও প্রাকৃতিক দেবদেবীর প্রশস্তি নিয়ে বৈদিক ছন্দে রচিত হয়েছে ঋকবেদের স্তোত্রগুলি। ঋকবেদে ১০১৭ টি স্তোত্র বা শ্লোক ছিল পরে সংযোজিত হয়ে মোট ১০২৮ টি হয়েছে। ঋকবেদে ১০৬০০ টি মন্ত্র আছে। ঋকবেদে দশটি মণ্ডল আছে। দ্বিতীয়-সপ্তম মণ্ডল সবথেকে পুরানো। তৃতীয় মণ্ডলে গায়ত্রী মন্ত্র আছে। গায়ত্রী মন্ত্র সাবিত্রীকে নিবেদিত।
সামবেদ: সাম বেদের স্তোত্রগুলি যজ্ঞের সময় গান করা হতো। সামবেদকে ভারতীয় সঙ্গীতের জনক বলা হয়।
যজুর্বেদ: যজুর্বেদে যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকলাপের নিদর্শন আছে। যজুর্বেদে ৪০ টি মণ্ডল ও ২০০০ টি স্তোত্র আছে। দুটি অংশে বিভক্ত- কৃষ্ণ যজুর্বেদ এবং শুক্ল যজুর্বেদ।
অথর্ববেদ: অথর্ববেদে শত্রু- দমন, কুসংস্কারমূলক আশঙ্কা ও অপদেবতা কর্তৃক আনীত অমঙ্গল দূরীকরণ, রোগ -নিবারণ, জাদু প্রভৃতি মন্ত্রের উল্লেখ দেখা যায়। ২০ টি খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থে ৭৩১ টি স্তোত্র ও প্রায় ৫৯৭৮ টি মন্ত্র আছে। গোত্র শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদে।
প্রতিটি বেদ আবার চারভাগে বিভক্ত:
- সংহিতা।
- ব্রাহ্মণ।
- আরণ্যক।
- উপনিষদ।
- সংহিতা: সংহিতা অংশটি যন্ত্র, স্তোত্র, প্রার্থনা, প্রার্থনা সঙ্গীত ও আশীর্বচনের সংকলন।
- ব্রাহ্মণ: ব্রাহ্মণ অংশে যাগ-যজ্ঞের বিধিব্যবস্থার নির্দেশ আছে। বেদের এই অংশটি গদ্যে লেখা। সর্ববৃহৎ ব্রাহ্মণ হল শতপথ ব্রাহ্মণ।
- আরণ্যক: যাঁরা বৃদ্ধ বয়সে সংসার জীবন ত্যাগ করে অরণ্যবাসী হতেন, তাদের জন্য ধর্মতত্ত্বের আলোচনা আছে এই আরণ্যকে।
- উপনিষদ: মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদ বেদের শেষ ভাগ তাই তা বেদান্ত নামেও পরিচিত। মোট উপনিষদের সংখ্যা ১০৮ টি। সত্যমেব জয়তে শব্দটি মুন্ডক উপনিষদ থেকে নেওয়া হয়েছে।
বেদাঙ্গ: বেদ পাঠের জন্য যে ছয়টি বিদ্যার প্রয়োজন হয় তাকে বেদাঙ্গ বলা হয়। এই ছয়টি বিদ্যা হল- শিক্ষা (বেদের বিশুদ্ধ উচ্চরণ), ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দের উৎপত্তির ব্যাখ্যা), জ্যোতিষ ও কল্প।